নাইর ইকবাল
ঢাকা
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১৯: ০৩
জাতীয় দলের জার্সিতে দারুণ অভিষেক সাগরিকারছবি: প্রথম আলো
২৪ জুলাই ভুটানের বিপক্ষে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে মোসাম্মাৎ সাগরিকা যখন মাঠে নামলেন, তখন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল ১ গোলে পিছিয়ে। ভুটান দেশটির বিপক্ষে বাংলাদেশের মেয়েরা এর আগে কখনোই হারেনি। এমনকি ড্র–ও করেনি। এমন একটা দলের বিপক্ষে প্রথমার্ধেই পিছিয়ে পড়াটা ছিল বেশ বড় ধাক্কাই। ইংলিশ কোচ পিটার বাটলার গোলের আশা নিয়ে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই সাগরিকাকে মাঠে নামিয়েছিলেন। বিপদের ভরসা হিসেবে গত ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব–১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে নিজেকে চিনিয়েছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের এই মেয়ে। ভুটানের বিপক্ষে সেই সাগরিকা কোচের আস্থার প্রতিদান দিলেন হ্যাটট্রিক করেই। পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ সেই ম্যাচে জিতল ৫–১ গোলে।
সাগরিকার ভরসা হয়ে ওঠার গল্পটা সবারই জানা। সাফ অনূর্ধ্ব–১৯ টুর্নামেন্টের ফাইনালে বাংলাদেশ ১–০ গোলে পিছিয়ে ছিল ৯০ মিনিট পর্যন্ত। যোগ করা সময়ে সাগরিকার গোলেই ম্যাচ বাঁচিয়েছিল তাঁর দল। সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনিই। ভুটানের বিপক্ষে ২৪ জুলাইয়ের ম্যাচটি ছিল জাতীয় দলের জার্সিতে তাঁর প্রথম ম্যাচ। গত মে–জুনে চীনা তাইপের বিপক্ষে দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে স্কোয়াডে থাকলেও খেলা হয়নি। ভুটানের বিপক্ষে মাঠে নেমেই হ্যাটট্রিক করাটা ১৯ বছর বয়সী এই ফুটবলারের সামর্থ্যের বড় প্রমাণ। অনূর্ধ্ব–১৯ সাফের সময়ই আলোচিত সাগরিকা আবারও প্রমাণ করেছেন দেশের নারী ফুটবলের জন্য তিনি বড় উপহারই।
২৭ জুলাই দ্বিতীয় ম্যাচেও গোল পেয়েছেন। দুই ম্যাচে ৪ গোল—এ যেন ঝড় তোলাই। কিন্তু ঝড় তুলেও তিনি আগের মতোই নির্লিপ্ত। যেমনটা দেখা গিয়েছিল সাফ অনূর্ধ্ব–১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের সময়। একই রকম লাজুক, ‘কোচ আমাকে বলেছিলেন, “তোমাকে নামাচ্ছি, গোল করতে হবে কিন্তু!” ভাগ্যবশত গোল পেয়েছি।’ আর হ্যাটট্রিক? সাগরিকার ঠোঁটে হাসির ঝিলিক, ‘ওটা করতে পেরে ভালো লাগছে।’ এমনভাবে বললেন যেন তেমন কিছুই করেননি। সামান্য একটা হ্যাটট্রিকই তো!
মেয়ের খেলা দেখতে সাগরিকার বাবা লিটন আলী মা আনজু বেগমকে সঙ্গে নিয়ে সেই ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকা এসেছিলেন গত ফেব্রুয়ারিতে। মেয়ে জানতই না তাঁদের ঢাকা আসার কথা। ফাইনালের দিন সকালে অশ্রুসজল বাবা বলেছিলেন, ‘মেয়েটা ফুটবল খুব ভালোবাসত বলে কত বকেছি। বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছি। কিন্তু আমার মেয়ে ফুটবল খেলেই এত মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছে। এই গর্ব আমি রাখি কোথায়?’
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে রানীশংকৈল উপজেলার রাঙাটুঙ্গি গ্রামে তাঁদের বাড়ি। রানীশংকৈল–হরিপুর সড়কের বলিদ্বারা নামের এক এলাকায় চায়ের দোকান আছে লিটন আলীর। সেই আয়েই চলে তাঁর সংসার। সাগরিকার ভাই সাগরও খুব ভালো ফুটবল খেলত। ‘খেলত’ বলার কারণ, অভাবের সংসারে রোজগারে ঢুকে যাওয়ায় সাগরের আর ফুটবল খেলা হয়নি।
ভুটানের বিপক্ষে থিম্পুর ম্যাচটি দেখতে মুঠোফোনে চোখ রেখেছিলেন লিটন আলী, ‘ভুটানে প্রথমে সাগরিকাকে মাঠে নামাননি কোচ। কিছুটা মন খারাপ যে হয়নি, সেটা বলব না। আগের দুটি ম্যাচেও (চীনা তাইপের বিপক্ষে) ওকে নামানো হয়নি। তবে পরে নেমে সে ৩ গোল করল। দেশ জিতেছে। আমরা সবাই খুব খুশি। তবে এটা তো মাত্র শুরু, ওকে অনেক পথ যেতে হবে। দোয়া করবেন সবাই।’
সাগরিকা নিজেও জানেন তাঁকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, ‘জাতীয় দলের হয়ে মাত্রই খেলা শুরু করলাম। দুই ম্যাচে গোল পেয়েছি। কিন্তু আমি জানি আমাকে কী করতে হবে। আমি অনূর্ধ্ব–১৯ সাফের সময় থেকেই জানি আমাকে কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে।’
সাগরিকার ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্পটা সংগ্রামের। ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় কোচ তাজুল ইসলামের শিষ্য হিসেবে বেড়ে ওঠা। পরিবার ও পারিপার্শ্বিকতার বাধা তাঁকে কাবু করতে পারেনি। আর্থিক সমস্যার কারণে মা–বাবা একটা বুটও কিনে দিতে পারেননি, কিন্তু সাগরিকা থামেননি। পৌঁছে গেছেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে।