নিহতদের মধ্যে ৬৭ শিশু–কিশোর 

নিহত শিশু-কিশোরদের মধ্যে ৫৭ জনের শরীরে গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। শিশু ও কিশোরদের মৃত্যু বড় ধাক্কা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে।

নাজনীন আখতার

ঢাকা

আপডেট: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ১৯: ১৬ 

কোটা সংস্কার আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র–জনতার বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতায় সারা দেশে কমপক্ষে ৬৭ শিশু–কিশোর নিহত হয়েছে। তাদের বেশির ভাগ, অর্থাৎ ৫৭ জনের মরদেহে গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৯ কিশোরের। একজনের মৃত্যু সাউন্ড গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

শিশু-কিশোরদের অনেকে বিক্ষোভে গিয়ে, অনেকে রাস্তা পার হওয়ার সময় নিহত হয়েছে। এমনকি বাসায় থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় (সাভার, টঙ্গীসহ) নিহত হয়েছে ৪০ জন। ঢাকার বাইরে ২৭ জন।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ১৬ জুলাই। ওই দিন ছয়জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে শিশু-কিশোর ছিল না। শিশু-কিশোর মৃত্যুর প্রথম ঘটনা ঘটে ১৮ জুলাই। ওই দিন থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৪০ জন শিশু-কিশোর। এ ছাড়া ৫ থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে আরও ২৭ শিশু-কিশোরের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়। 

প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ৬২৪ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত নিহত হন কমপক্ষে ৩৫৪ জন। আর ৫ থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত আরও অন্তত ২৭০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

তবে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত বিক্ষোভ ও পরবর্তী সহিংসতায় কমপক্ষে ৬৫০ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও অস্থিরতা বিষয়ে প্রাথমিক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন গতকাল জেনেভা থেকে প্রকাশিত হয়।

বিক্ষোভে শিশু ও কিশোরদের মৃত্যু বড় ধাক্কা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাসটিকে কাল্পনিক হিসাবে ফেলে তা ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৩৬ জুলাই হিসেবে গণনা করেন (জুলাই মাস ৩১ দিনের, এই মাসের সঙ্গে আরও ৫ দিন যুক্ত করা হয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়) শিক্ষার্থীরা। এটিকে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেন তাঁরা।

বিক্ষোভের মধ্যে নিহত হওয়া রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফারহান ফাইয়াজের (১৭) হাসিমুখের ছবি, রিকশার পাদানিতে চিত হয়ে ঝুলতে থাকা গোলাম নাফিজ (১৭), ছোট্ট কাঁধেই সংসারের ভার নেওয়া শনির আখড়ার হকার হোসেন মিয়া (১০) এবং দুধ বিক্রেতা মোবারক আলীর (১০) জীবনের গল্প সাধারণ মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তৈরি করছে ।

গুলিতে নিহত ছয় বছরের রিয়া গোপের মাথায় ব্যান্ড পরা একটি ছবি এখন রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতিতে স্থান পেয়েছে। বাসার ছাদে খেলতে থাকা রিয়ার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে অণুগল্প।

এ ধরনের হত্যাকে গণহত্যা বলে উল্লেখ করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে কখনো হয়নি। তখন অন্য দেশ ছিল প্রতিপক্ষ। এবার কীভাবে নিজের দেশের মানুষের হাতে মানুষ নিহত হয়?’

রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘জাতি হিসেবে লজ্জা লাগছে, কষ্ট লাগছে, অবিশ্বাস্য লাগছে। আমরা শিশুহত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করি। এখন নিজের দেশের শিশুহত্যা নিয়ে আমরা কী বলব?’

৩৩ জন শিক্ষার্থী

শিশু আইন ২০১৩ অনুসারে, ১৮ বছরের নিচের বয়সীরা শিশু। নিহত শিশু-কিশোরদের বয়স ৪ থেকে ১৭ বছর। তাদের মধ্যে ৩৩ জন শিক্ষার্থী। ২০ জন শিশুশ্রমে নিযুক্ত। তাদের কেউ দোকানে, কেউ পোশাক কারখানায়, কেউ হকার হিসেবে কাজ করে পরিবারের জন্য আয় করত। ১৩ জনের পেশা জানা যায়নি। এ ছাড়া নিহতদের তালিকায় ৪ বছরের শিশুও রয়েছে। তার নাম আবদুল আহাদ। সে স্কুলে যাওয়া শুরু করার আগে গুলিতে প্রাণ হারিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।

আহাদ বাসার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। ১৯ জুলাই বেলা দেড়টার দিকে সে গুলিবিদ্ধ হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

১৯ জুলাই সন্ধ্যায় রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে দোতলা বাসার খোলা জানালা দিয়ে গুলি ঢুকে শিশু সামিরুর রহমানের (সাফকাত সামির) চোখ ও মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। বাবা সাকিবুর রহমান এবং মা ফারিয়া ইবনাতের একমাত্র সন্তান ছিল সামির (১১)। বাসার কাছে একটি মাদ্রাসায় পড়ত সে।

শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

বিশেষ আদালত গঠন করে শিশু–কিশোর হত্যার বিচার হওয়া হওয়া উচিত বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে হেলিকপ্টার থেকে পর্যন্ত গুলি করে ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি করেছিল। শিশু–কিশোরদের প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং সঠিক বিচার হওয়া জরুরি।

‘শিশুর কী দোষ ছিল’

বিক্ষোভ দমনে ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই নির্বিচার গুলিবর্ষণের অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে। অবশ্য ওই সব ঘটনায় জুলাই মাসে যে মামলাগুলো হয়েছিল, তাতে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মানুষের মৃত্যু হয় বলে দাবি করেছিল পুলিশ। 

৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করেন। তাঁদের কারও কারও হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশি অস্ত্র। ওই হামলায় নিহত হয় তিন কিশোর, তারা ছিল শিক্ষার্থী। 

মৃত্যু ছাড়াও অনেক শিশু-কিশোর আহত হয়েছে। তাদের কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছিল। যদিও সমালোচনার মুখে পরে তাদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার গত ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে, তদন্তও শুরু হয়েছে; কিন্তু স্বজনদের প্রশ্ন—হারানো শিশুরা কি আর ফিরে আসবে?

গুলিতে নিহত সাফকাত সামিরের চাচা মবিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১১ বছরের শিশুর কী দোষ ছিল? কেন সে বাসার ভেতরেও নিরাপদ থাকতে পারল না?