আনোয়ার হোসেন

ঢাকা

আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯: ৩৪ 

৭২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রেললাইন, ট্রেন চলে কম

রাজবাড়ী থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ ও পুরোনো লাইন সংস্কারে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করার সময় বলা হয়েছিল, এই রেললাইন দিয়ে দিনে ১৪টি ট্রেন চলাচল করবে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন এই রেলপথ উদ্বোধন করেন। এখন এই পথে ট্রেন চলছে মাত্র দুটি।

রাজবাড়ী–গোপালগঞ্জের মতো ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্মিত আটটি রেললাইন সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাকি সাতটি রেললাইন হলো পাবনা–ঢালারচর, কুমিল্লার লাকসাম–চিনকি আস্তানা (চট্টগ্রামের কাছে), চট্টগ্রামের দোহাজারী–কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া–কুমিল্লার লাকসাম, খুলনা–মোংলা, আখাউড়া–আগরতলা (ভারত) এবং পদ্মা রেলসংযোগ (ঢাকা থেকে যশোর)। এগুলো নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৭১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। কিন্তু সুফল কম। ফলে রেললাইনগুলোকে বলা হচ্ছে ‘সাদা হাতি’।

‘সাদা হাতি’ বাগ্‌ধারাটি দিয়ে বোঝানো হয়, যার পেছনে প্রচুর ব্যয় হয়, কিন্তু সুফল পাওয়া যায় না। থাইল্যান্ডে রাজারা সাদা হাতি পুষতেন। প্রাণীটিকে ধরা হতো পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে। সাদা হাতি দিয়ে কোনো কাজ করানো নিষিদ্ধ ছিল। রাজারা কারও ওপর নাখোশ হলে তাঁকে বিপাকে ফেলতে সাদা হাতি উপহার দিতেন। উপহার পাওয়া ব্যক্তি সাদা হাতি পুষতে গিয়ে আর্থিক দুর্দশার মধ্যে পড়তেন।

সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ওই সব প্রকল্পের কোনোটি নেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়, কোনোটি অর্থায়নকারী কোনো দেশের পরামর্শে, কোনোটি ঠিকাদারদের তৎপরতায়। এখন প্রকল্পগুলো দেশের মানুষের জন্য বোঝায় পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকার যে ১৮ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ রেখে গেছে, তার একটি অংশ দিয়ে এমন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল।

রেললাইন প্রকল্পগুলোর নির্মাণ ব্যয় ও মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই আট প্রকল্পের ছয়টি বাস্তবায়নে নিয়োজিত ছিল চীনের কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পাঁচটিতে তাদের অংশীদার ছিল বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান। দুটিতে কাজ করেছে ভারতীয় ঠিকাদার।

এগুলো নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৭১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। কিন্তু সুফল কম। ফলে রেললাইনগুলোকে বলা হচ্ছে ‘সাদা হাতি’।

বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে ম্যাক্স গ্রুপ ও তমা কনস্ট্রাকশন।

সূত্র বলছে, মূলত বাংলাদেশি প্রভাবশালী ঠিকাদারেরা কাজ পাওয়ার যোগ্যতা বাড়াতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনে রাখেন। কাজ পাওয়া এবং বাস্তবায়নে স্থানীয় ঠিকাদারেরাই মূল ভূমিকা পালন করেন। একমাত্র পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পে চীনা ঠিকাদার মূল ভূমিকায় ছিল।

বেশি কাজ পাওয়া তমা কনস্ট্রাকশনের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে অংশ নিয়ে তিনি পরাজিত হন। তমা কনস্ট্রাকশনের পেছনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম রয়েছেন বলে আলোচনা আছে। আত্মগোপনে থাকায় মির্জা আজমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ওই সব প্রকল্পের কোনোটি নেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়, কোনোটি অর্থায়নকারী কোনো দেশের পরামর্শে, কোনোটি ঠিকাদারদের তৎপরতায়। এখন প্রকল্পগুলো দেশের মানুষের জন্য বোঝায় পরিণত হয়েছে।

প্রতিযোগিতা করে বেশি কাজ পাওয়া দোষের কিছু নয় বলে দাবি করেন তমা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মির্জা আজম তাঁর প্রতিষ্ঠানের অংশীদার নন। তবে তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু। ঘনিষ্ঠতার কারণে মানুষ অপপ্রচার করে।

অবশ্য রেল, সড়ক, নৌসহ বিভিন্ন খাতে বিগত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তমা কনস্ট্রাকশন। অভিযোগ আছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে তারা বেশি কাজ পেত।

রাজবাড়ী থেকে টুঙ্গিপাড়া

রাজবাড়ী থেকে টুঙ্গিপাড়া রুটে ৭৮ কিলোমিটার পুরোনো রেললাইন সংস্কার এবং ৪৪ কিলোমিটার ব্রডগেজ মেইন ও ৮ কিলোমিটার শাখা লাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্প অনুমোদন হয় ২০১০ সালে। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। কাজ শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর পর, ২০১৮ সালে।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, শেখ হাসিনার ইচ্ছায় কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই এ প্রকল্প নেওয়া হয়। এই পথে নতুন রেলপথ, সেতু ও স্টেশন ভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণের মূল কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, শেখ হাসিনার আগ্রহে ফরিদপুরের মধুখালী থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে মাগুরা পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এটিও নেওয়া হয়েছে সমীক্ষা ছাড়া। ব্যয় ১ হাজার ২০২ কোটি টাকা। প্রকল্পটির আওতায় প্রায় ২৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ ও বাংলাদেশের ক্যাসল কনস্ট্রাকশন।

ক্যাসল কনস্ট্রাকশন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।

অবশ্য রেল, সড়ক, নৌসহ বিভিন্ন খাতে বিগত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তমা কনস্ট্রাকশন। অভিযোগ আছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে তারা বেশি কাজ পেত।